Saturday, March 31, 2012

ডেসটিনি অবৈধ ব্যাংকিং করছে


বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন

ডেসটিনি অবৈধ ব্যাংকিং করছে

ফখরুল ইসলাম | তারিখ: ৩০-০৩-২০১২

ডেসটিনি গ্রুপের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি অবৈধ ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া তারা একদিকে যেমন আমানত সংগ্রহ করছে, অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হয়েও শেয়ার বিক্রি করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডেসটিনি গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান জনগণের কাছ থেকে মাসে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। ৪০ লাখ প্রতিনিধির মাধ্যমে ব্যাংকের মতো রীতিমতো আমানত সংগ্রহ করছে তারা। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হয়েও বিক্রি করছে এর শেয়ার। তথাকথিত শেয়ার বিক্রি করেই প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নিয়েছে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে যে তারল্য-সংকট রয়েছে, এর জন্য ডেসটিনির মতো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিগুলোর যোগসূত্র থাকতে পারে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংক বা পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ না করে সরাসরি জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করায় ব্যাংক ব্যবসা ও মূলধন বাজার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে।
সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বহুসংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির যোগসূত্র থাকায় অনেক সাধারণ মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রতিবেদন গত রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের সভাপতি হলেন ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন। এ ছাড়া উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোহাম্মদ গোফরানুল হক, পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ সাইদ-উর রহমান, পরিচালক (ক্রয়) মেজবাহ উদ্দীন, মোহাম্মদ হোসাইন প্রমুখ। এ ছাড়া ব্যবস্থাপনা ও উপদেষ্টা পর্ষদে তাঁদের আত্মীয়স্বজন রয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিনব মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পদ্ধতি অবলম্বন করছে। বিনিময়ে আমানত সংগ্রহকারীদের কমিশন দেওয়া হচ্ছে, যা অবৈধ ও অনৈতিক। প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়তে পারে এবং প্রতারিত হতে পারে জনগণ।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে কোনো ব্যয় না করলেও ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৯৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যয় দেখিয়েছে ৬৫৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অথচ এর কোনো গবেষণাগার ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র নেই।
অবৈধ ব্যাংকিং: প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যমান ২০০১ সালের সমবায় সমিতি আইনের অজুহাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো আমানত সংগ্রহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১১ সাল পর্যন্ত সংগ্রহ করেছে দুই হাজার কোটি টাকা। সমিতির শেয়ারহোল্ডারদের দায়দায়িত্ব তাদের পরিশোধিত মূলধনের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়। তবে কখনো যদি অবসায়ন ঘটাতে হয়, তখন পরিসম্পদে ঘাটতি থাকলে সদস্যরা নিজ নিজ শেয়ার অনুপাতে দায়ী থাকবেন। প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ শেয়ারহোল্ডার এ সম্পর্কে অবগত নন। প্রতিষ্ঠানটি শেয়ার মূলধন ও শেয়ারহোল্ডারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িয়ে অত্যন্ত সুচতুরভাবে এর দায়দেনার সঙ্গে লাখ লাখ মানুষকে সম্পৃক্ত করছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
বেআইনি শেয়ার বিক্রি: ডেসটিনির সদস্য হলেই ‘ডিস্ট্রিবিউটরস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর’ (ডিআইএন) ও ‘কাস্টমারস আইডেন্টিফিকেশন’ (সিআইডি) দেওয়া হয়। বর্তমানে সিআইডি নম্বরধারীর সংখ্যা ৬৮ থেকে ৭০ লাখ এবং ডিআইএন নম্বরধারী ৪০ থেকে ৪৫ লাখ। ডিআইএন নম্বরধারীরাই ডেসটিনি মাল্টিপারপাসের সদস্য।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪০টি শেয়ারের একটি লট ২০ হাজার টাকা করে বিক্রি করছে এই ডিআইএনরা। শেয়ার বিক্রি করতে পারলে ৫০০ পয়েন্ট ভ্যালু (পিভি) অর্জন করা যায়। আশ্চর্যজনক যে, পরিবেশক করা হয় ডেসটিনি গ্রুপের মূল প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের। আবার এই পরিবেশক হওয়াই ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির সদস্য হওয়ার পূর্বশর্ত। আবার এক লাখ টাকার মেয়াদি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেও কোনো ব্যক্তি সদস্য হতে পারেন।
প্রলুব্ধ করে তহবিল বৃদ্ধি: পাঁচ বছর আগেও প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা ছিল। বর্তমানে তা তিন হাজার কোটি টাকা, যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে।
প্রতিবেদনমতে, প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকের মতো চলতি, স্থায়ী, সাড়ে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ, মাসিক মুনাফা, শেয়ার মূলধন ইত্যাদি প্রকল্পের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ করছে। এর জন্য প্রশিক্ষিত মাঠকর্মী তথা কমিশন এজেন্টদের ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শহরের আনাচে-কানাচে ও প্রত্যন্ত গ্রামে।
এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার শেয়ার সংগ্রহও আমানতেরই নামান্তর। ২০০৬-০৭ সালে ৭১ লাখ, ২০০৭-০৮ সালে সাত কোটি দুই লাখ, ২০০৮-০৯ সালে ১৭ কোটি ৫৬ লাখ, ২০০৯-১০ সালে ২২২ কোটি ১৮ লাখ এবং ২০১০-১১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৫২২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে বর্তমানে ৯৪ শতাংশ আমানতই দীর্ঘমেয়াদি আমানত।
আমানতের বিপরীতে সুদ দেওয়া হয় সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ। সমবায় আইন অনুযায়ী আয়ের টাকা যেহেতু করমুক্ত, তাই সুদের এত উচ্চহার অস্বাভাবিক। আমানত পরিশোধের দায়বদ্ধতা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত শেয়ার ক্রয়ে জনগণকে প্রলুব্ধ করে তহবিল বাড়াচ্ছে।
অস্বচ্ছ হিসাব পদ্ধতি: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরীক্ষার বাধ্যবাধকতা না থাকায় যেকোনো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের মতো ডেসটিনিরও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করেছে সমবায় অধিদপ্তর। এতেও অনেক ত্রুটি ধরা পড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরের শাখাওয়ারি সঞ্চয় সংগ্রহ, শেয়ার মূলধন, আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাবই নেই। ওই বছর অনুমোদনবিহীন ব্যয় হয়েছে ২১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। সঞ্চয় ও শেয়ার মূলধন আহরণে কমিশন বাবদ ব্যয় হওয়া ২০০ কোটি টাকাকে গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয় দেখানো হয়েছে, যা হিসাবশাস্ত্রের রীতিনীতির পরিপন্থী।
স্থিতিপত্রে প্রাপ্তি ও প্রদানে কোনো মিল নেই এবং প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত চিত্র এতে প্রতিফলিত হয় না। প্রতিষ্ঠানটি জনগণের কাছ থেকে যে পরিমাণ সঞ্চয় ও শেয়ার মূলধন সংগ্রহ করেছে বলে নিরীক্ষা দলকে জানিয়েছে, তা-ও সঠিক নয়। বরং প্রকৃত সংগ্রহের পরিমাণ অনেক বেশি।
নিজেদের প্রতিষ্ঠানে টাকা সরানো: প্রতিবেদনমতে, ডেসটিনি মাল্টিপারপাসের নামে জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থে মূলত জমি কেনা হচ্ছে। তবে জমির দলিল কার নামে হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। আরও অর্থ নেওয়া হচ্ছে ডেসটিনি গ্রুপের ডেসটিনি ২০০০, ডেসটিনি ডায়মন্ড সিটিসহ ১৩টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানটি এখন মুনাফা অর্জন করছে মনে হলেও গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের কমিশন সমন্বয় করলে এর নিট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে সমবায় সমিতির বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিতে তারল্য ঘাটতি রয়েছে। তারল্য-সংকটের কারণে যেকোনো সময় আমানতের টাকা ফেরতে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে। আমানতকারীদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে আস্থাহীনতার মনোভাব।
সচিবের কাছে চিঠি: প্রতিবেদন পাঠানোর পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারীর কাছে একটি চিঠিও পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, ডেসটিনির বর্তমান প্রতারণামূলক ও অভিনব এমএলএম কার্যক্রম, উচ্চ হারে ও অযৌক্তিকভাবে মূলধন বৃদ্ধি এবং সংগ্রহীত আমানত ও মূলধন সুকৌশলে অন্যান্য কোম্পানিতে সরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি অনিয়মের বিষয় আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে এ ধরনের উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। বিস্তারিত তদন্ত করে ডেসটিনির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতেও সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
যোগাযোগ করলে সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ডেসটিনির মতো আরও প্রতিষ্ঠান একই ধরনের কার্যক্রমে লিপ্ত। বিষয়টির সত্যিই একটি বিহিত করা দরকার।
বক্তব্য নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করলে ডেসটিনির গণমাধ্যম উপদেষ্টা মাহমুদ আল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীন এই মুহূর্তে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন এবং দেশে ফিরেই তিনি কথা বলবেন। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বক্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন, সবকিছুই এমডি। তিনি ছাড়া কারও পক্ষে কথা বলা সম্ভব নয়।

Saturday, March 17, 2012

শচীনের শততম সেঞ্চুরি, ভারত ২৮৯

বাংলাদেশের বিপক্ষেই ক্যারিয়ারের শততম সেঞ্চুরিটা তুলে নিলেন শচীন টেন্ডুলকার। ঘুচালেন দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময়ের সেঞ্চুরি- খরা। অবসান ঘটালেন ভক্তদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। মিরপুরে এশিয়া কাপের চতুর্থ ম্যাচে শচীনের সেঞ্চুরির উপর ভর করে বড় সংগ্রহ দাড় করিয়েছে ভারত। নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৫ উইকেট হারিয়ে স্কোরবোর্ডে ২৮৯ রান জমা করেছে বিশ্বকাপজয়ীরা।
মাশরাফি বিন মুর্তজার শিকারে পরিণত হওয়ার আগে শচীন করেন ১১৪ রান। ১৪৭ বলে লিটল মাস্টারের এই ইনিংসে ছিল একটি ছয় ও ১২টি চারের মার।
দ্বিতীয় উইকেটে শচীনের সঙ্গে ১৪৮ রানের জুটি গড়ে সাজঘরে ফেরেন বিরাট কোহলি (৬৬)। সুরেশ রায়না আউট হন ৫১ রানে। দিবা-রাত্রির এই ম্যাচে টস জিতে ফিল্ডিং করার নেন বাংলাদেশের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম।
শক্তিমত্তার বিচারে আজকের ম্যাচে ভারতীয় দল এগিয়ে, বলার অবকাশ রাখে না। চলতি আসরেও এগিয়ে ভারত। প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে ২১ রানে হেরেছে স্বাগতিক বাংলাদেশ। অন্যদিকে, নিজেদের প্রথম ম্যাচে হেসে-খেলে শ্রীলঙ্কাকে ৫০ রানে হারায় ভারত।

বাংলাদেশের অসাধারণ জয়

শচীন টেন্ডুলকারের দীর্ঘ প্রতীক্ষার শততম সেঞ্চুরিটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত ধরে রেকর্ড-বুকে জায়গা করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু টেন্ডুলকারের ইতিহাস-গড়া এ দিনটিতে শুধু নিষ্ক্রিয়ভাবেই থাকতে চাননি স্বাগতিকেরা। এশিয়া কাপের চতুর্থ ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেটের অসাধারণ এক জয় দিয়ে ম্যাচটা দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো একটা ম্যাচে পরিণত করেছে সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাশরাফিরা। তামিম, জহুরুল, নাসির, সাকিব, মুশফিকের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে মাত্র ৫ উইকেট হারিয়ে ৪ বল হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় টাইগাররা।
ভারতের বিপক্ষে ২৯০ রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালোভাবে করতে পারেনি বাংলাদেশ। পঞ্চম ওভারেই প্রাভিন কুমারের শিকারে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফিরেছেন ওপেনার নাজিমুদ্দিন। তবে দ্বিতীয় উইকেটে ১১৩ রানের জুটি গড়ে প্রাথমিক বিপর্যয় সামলে বেশ ভালোই লড়াই চালিয়েছিলেন আরেক ওপেনার তামিম ইকবাল ও জহুরুল ইসলাম। কিন্তু দলীয় ১২৮ রানের মাথায় রবীন্দ্র জাদেজার শিকারে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফিরেছেন জহুরুল। তবে তার আগে তিনি দেখা পেয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতকের। আউট হয়েছেন ৫৩ রান করে। তারপর খুব বেশিক্ষণ উইকেটে থাকতে পারেননি তামিমও। তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ৭০ রানের লড়াকু ইনিংস। চতুর্থ উইকেটে ৬৮ রানের জুটি গড়ে জয়ের পথে বাংলাদেশকে আরও কিছুটা এগিয়ে দেন সাকিব ও নাসির। কিন্তু ব্যক্তিগত ৪৯ রানের মাথায় থার্ড আম্পায়ারের কিছুটা বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বলি হয়ে সাজঘরে ফিরেছেন সাকিব। তবে তাতেও জয় পেতে সমস্যা হয়নি বাংলাদেশের। শেষ পর্যায়ে ঝোড়ো ব্যাটিং করে জয় নিশ্চিত করেছেন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম ও নাসির হোসেন। জয়ের জন্য যখন আর মাত্র ২ রান দরকার তখন ৬ মেরে জয় পাওয়ার তাড়নায় প্রাভিন কুমারকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট হন নাসির (৫৪)। মুশফিকুর শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ২৫ বলে ৪৬ রানের ইনিংস খেলে।

বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ

বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ-এর বাংলায় প্রথম অনুবাদের সোয়া শ বছর পেরিয়ে গেছে আজ থেকে এক বছর আগে। একেবারে নীরবে। কাউকে কিছু জানান না দিয়ে। অথচ গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) ছয় বছর দীর্ঘ (১৮৮১-১৮৮৬) কঠোর ও একাগ্র শ্রমে যখন কোরআন শরিফ-এর অনুবাদের কাজ শেষ করেছিলেন, তখন সেটা গোটা বাংলা ভাষাভাষী সমাজে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা হয়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক ঘটনা তো বটেই। কোরআন শরিফ-এর সঠিক অনুবাদ সেই প্রথম। অমন পরিশ্রমসাধ্য কাজের দৃষ্টান্ত সত্যিই এক বিরল ঘটনা। অবশ্য মাওলানা মহিউদ্দিন খান নামের একজন বিশিষ্ট আলেম পবিত্র কোরআন শরিফ-এর প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছিলেন বলে যে দাবি করা হয়, তার অনুকূলে তেমন জোরালো কোনো সমর্থন বা তথ্য পাওয়া যায় না। যদি যেত, তাহলে ১৯৩৬ সালে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) কেন এ কথা বলতে যাবেন, ‘তিন কোটি মোছলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা তাহাতে কোরআনের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা ১৮৭৬ খ্রি. পর্যন্ত এ দেশের কোনো মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তখন আরবি-পারসি ভাষায় সুপণ্ডিত মোছলমানের অভাব ছিল না।...কিন্তু এদিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তাঁহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই। এই গুরুদায়িত্বভার বহন করিবার জন্য সুদৃঢ় সংকল্প নিয়া, সর্বপ্রথমে প্রস্তুত হইলেন বাংলার একজন হিন্দু সন্তান, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন—বিধান-আচার্য কেশবচন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে।’ এই ঘটনার উল্লেখ শেষে মাওলানা আকরম খাঁর মন্তব্য, ‘গিরিশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’
গিরিশচন্দ্রের জন্ম তখনকার ঢাকা জেলা, বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার মহেশ্বরদি পরগনার পাঁচদোনা গ্রামে। নবাব আলিবর্দী খাঁর দেওয়ান দর্পনারায়ণ রায়ের বংশে তাঁর জন্ম। ফারসি ভাষা চর্চার জন্য এই বংশের সুনাম ছিল। পাঁচ বছর বয়সেই তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল। সাত বছর বয়সেই ফারসি ভাষা শিক্ষা আরম্ভ করেন। ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর অনীহা ছিল। ফলে ১৩-১৪ বছর বয়সে তাঁকে মুন্সি কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কাছে ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮-১৯ বছর বয়সে তাঁকে তাঁর এক ভাই ময়মনসিংহে নিয়ে যান এবং ফারসি সাহিত্যে যাতে বুৎপত্তি লাভ করতে পারেন, সে জন্য একজন ভালো মওলানার হাতে তাঁকে তিনি তুলে দেন। সংসদ চরিতাভিধান-এর মতে, এরপর তিনি ময়মনসিংহ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারিতে নকলনবিশের কাজ করতেন। কিন্তু সে কাজ তাঁর ভালো লাগত না। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণের প্রভাবে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন এবং গ্রহণ করেন এই ধর্মের প্রচারকের ব্রত। সর্বধর্মসমন্বয়ে উৎসাহী ভাই গিরিশচন্দ্র কেশবচন্দ্রের আদেশে ইসলাম ধর্ম অনুশীলনে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। আরবি ভাষা ও ইসলাম ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লক্ষ্নৌ যান। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর আত্মজীবনী আত্ম-জীবন-এ লেখেন, ‘মোসলমান জাতির মূল ধর্মশাস্ত্র কোরআন শরীফ পাঠ করিয়া এসলাম ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব অবগত হইবার জন্য আমি ১৮৭৬ খৃঃ লক্ষ্নৌ নগরে আরব্যভাষা চর্চা করিতে গিয়াছিলাম।’ তখন তাঁর বয়স ছিল ৪২ বছর। তাঁর শিক্ষক ছিলেন ‘সুবিজ্ঞ’ বৃদ্ধ মৌলবি এহসান আলী। ‘আরব্য ব্যাকরণ এবং পারস্য দেওয়ান হাফেজের’ চর্চা করতেন তাঁর কাছে। মৌলবি এহসান আলী সাহেব গিরিশচন্দ্রকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এরপর লক্ষ্নৌ থেকে আরবি ব্যাকরণের চর্চা শেষে কলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানেও তিনি একজন মৌলবির কাছে আরবির পাঠ নিতেন নিয়মিত। পরে ঢাকায় এসে মৌলবি আলিমুদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে আরবের ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ নেন। এ সময়ই গিরিশচন্দ্রের কোরআন শরিফ পাঠের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু অন্য ধর্মে বিশ্বাসী বলে এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তাঁর পক্ষে সরাসরি সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। ফলে তিনি ‘ঢাকা নগরস্থ সমবিশ্বাসী বন্ধু’ মিঞা জালালউদ্দিনের মাধ্যমে একখানা কোরআন সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। তাঁর আত্ম-জীবন-এ তিনি এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এরপর আমি তফসির ও অনুবাদের সাহায্যে পড়িতে আরম্ভ করি। যখন আমি তফসিরাদির সাহায্যে আয়াত সকলের প্রকৃত অর্থ কিছু কিছু বুঝিতে পারিলাম, তখন তাহা অনুবাদ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।’
কোরআন শরিফ-এর বাংলায় অনুবাদের কাজটা মূলত শুরু হয় ১৮৮১ সালের শেষভাগ থেকে। গিরিশচন্দ্র তখন ময়মনসিংহ শহরে বসবাস করতেন। অল্প অল্প করে অনুবাদ করে তা খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করতে থাকেন। আত্ম-জীবন-এ এর বিবরণ দিয়ে তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘শেরপুরস্থ চারুযন্ত্রে প্রথম খণ্ড মুদ্রিত হয়, পরে কলকাতায় আসিয়া খণ্ডশঃ আকারে প্রতিমাসে বিধানযন্ত্রে মুদ্রিত করা যায়। প্রায় দুই বছরে কোরআন সম্পূর্ণ অনুবাদিত ও মুদ্রিত হয়। পরিশেষে সমুদয় এক খণ্ডে বাঁধিয়া লওয়া যায়। প্রথমবারে সহস্র পুস্তক মুদ্রিত হইয়াছিল, তাহা নিঃশেষিত হইলে পরে ১৮৯৮ সালে কলকাতা দেবযন্ত্রে তাহার দ্বিতীয় সংস্করণ হয়। দ্বিতীয়বারের সহস্র পুস্তকও নিঃশেষিত প্রায়। এখন (১৯০৬ খ্রি.) সংশোধিত আকারে তাহার তৃতীয় সংস্করণের উদ্যোগ হইতেছে।’
অবশ্য একজন ভিন্ন ধর্মমতের ব্যক্তিপুরুষ পবিত্র কোরআন শরিফ অনুবাদ করায় তখনকার মুসলমান সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ যে ক্ষুব্ধ ও ক্রোধান্বিত হয়নি, তা নয়। হয়েছিল। কেশবচন্দ্র তাদের সেই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে দুঃখ পেয়েছিলেন এবং মুসলমান সমাজের প্রতি তাঁর সর্বধর্মসমন্বয়বাদের মন্ত্র ও আদর্শের পক্ষে সুদৃঢ় অভিমত তুলে ধরেছিলেন। বাংলায় পবিত্র কোরআন শরিফ-এর অনুবাদের ঘটনায় তিনি অপরিসীম আনন্দ পেয়েছিলেন।
তবে শিক্ষিত ও উদার স্বাধীনচেতা মুসলমানদের বৃহত্তর অংশ গিরিশচন্দ্র সেনের বাংলা অনুবাদে পবিত্র কোরআন শরিফ পেয়ে যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিল, এক অর্থে তা অভাবিত ও অভূতপূর্ব। তখনকার কলকাতা মাদ্রাসার ভূতপূর্ব আরবি শিক্ষক আহমদউল্লা এবং আরও কিছু আলেম-উলেমা অনুবাদকের উদ্দেশে ইংরেজিতে যে চিঠি লিখেছিলেন, বাংলায় তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলো। তাঁরা বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাসে ও জাতিতে মোসলমান। আপনি নিঃস্বার্থভাবে জনহিত সাধনের জন্য যে এতাদৃশ চেষ্টা ও কষ্টসহকারে আমাদিগের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকার সাধনে নিযুক্ত হইয়াছেন, এজন্য আমাদিগের অত্যুত্তম ও আন্তরিক বহু কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি দেয়।
‘কোরআনের উপরিউক্ত অংশের অনুবাদ এতদূর উৎকৃষ্ট ও বিস্ময়কর হইয়াছে যে, আমাদিগের ইচ্ছা, অনুবাদক সাধারণসমীপে স্বীয় নাম প্রকাশ করেন। যখন তিনি লোকমণ্ডলীর এতাদৃশ উৎকৃষ্ট সেবা করিতে সক্ষম হইলেন, তখন সেই সকল লোকের নিকটে আত্মপরিচয় দিয়া তাহার উপযুক্ত সম্ভ্রমলাভ করা উচিত।’
উল্লেখ করা যেতে পারে, পবিত্র কোরআন শরিফ ভাই গিরিশচন্দ্র অনুবাদ করেছিলেন নিজের নামস্বাক্ষরহীনভাবে। যখন তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেলেন, প্রশংসা পেলেন এবং সেটা স্বয়ং মুসলমান সমাজের কাছ থেকে, তখন তিনি স্বনামে তা প্রকাশ করলেন। এবং এ সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ‘অনুবাদকের বক্তব্যে’ বললেন, ‘আজ কোরআনের অনুবাদ সমাপ্ত দেখিয়া আমার মনে যুগপৎ হর্ষ-বিষাদ উপস্থিত। হর্ষ এই যে, এতকালের পরিশ্রম সার্থক হইল। বিষাদ এই যে, ইহার প্রথমাংশ শ্রীমদাচার্য কেশবচন্দ্র সেনের করকমলে অর্পণ করিয়াছিলাম; তিনি তাহা পাইয়া পরমাহ্লাদিত হইয়াছিলেন ও তাহার সমাপ্তি প্রতীক্ষা করিতেছিলেন; শেষাংশ আর তাহার চক্ষুর গোচর করিতে পারিলাম না। ঈশ্বর তাহাকে আমাদের চক্ষুর অগোচর করিলেন। তিনি এই অনুবাদের এরূপ পক্ষপাতী ছিলেন যে, তাহার নিন্দা কেহ করিলে সহ্য করিতে পারিতেন না। আজ অনুবাদ সমাপ্ত দেখিলে তাহার কত না আহ্লাদ হইত, দাসও তাহার কত আশীর্বাদ লাভ করিত।’
এর পর থেকে তিনি মুসলমান ধর্ম বিষয়ে তাঁর অধ্যয়ন ও অনুবাদের পরিধি ক্রমাগত বাড়িয়ে চললেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আরবি ও ফারসি থেকে হাদিসসহ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), খলিফাবৃন্দ, মুসলমান মনীষীবর্গের জীবনীসহ অন্য বহু বিষয়ে মোট ৪২টি গ্রন্থ বাংলায় রচনা ও প্রকাশ করেন।
এর পর থেকে বাংলার মুসলমান সমাজে যাতে গিরিশচন্দ্রের বাংলায় অনূদিত কোরআন শরিফ বহুল পরিমাণে বিক্রি, প্রচার ও আদৃত হয়, তার জন্যও চেষ্টা করেছিলেন তাঁর অনেক মুসলমান বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। বাংলা ১২৮৮ সনের ৬ ফাল্গুন আবুয়ল্ মজফ্র আবদুল্লাহ নামের একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি পত্র মারফত অনুবাদককে জানান, ‘মহাশয়ের বাংলা ভাষায় অনুবাদিত কোরআন শরিফ দুই খণ্ড উপহার প্রাপ্ত হইয়া অতি আহ্লাদের সহিত পাঠ করিলাম। এই অনুবাদ আমার বিচেনায় অতি উত্তম ও শুদ্ধরূপে টীকাসহ হইয়াছে। আপনি তফসীর হোসেনী ও শাহ আবদুল কাদেরের তফসীর অবলম্বন করিয়া যে সমস্ত টীকা লিখিয়াছেন এজনের ক্ষুদ্র বিদ্যাবুদ্ধিতে পর্যন্ত বুঝিতে পারিয়াছি, তাহাতে বোধ করি যে, এ পর্যন্ত কোরআন শরীফের অবিকল অনুবাদ অন্য কোনোও ভাষাতেই করা হয় নাই, এবং আমি মনের আহ্লাদের সহিত ব্যক্ত করিতেছি যে, আপনি যে ধর্ম্ম উদ্দেশ্যে যার পর নাই পরিশ্রম স্বীকার করিয়া এই অনুবাদ করিয়াছেন, ইহার ফল ঈশ্বর আপনাকে ইহ ও পরকালে প্রদান করুন।’
এবং ১৯৩৬ সালে যখন ভাই গিরিশচন্দ্রের কোরআন শরিফ-এর চতুর্থ সংস্করণ কলকাতা থেকে বের হচ্ছে, তার ভূমিকায় মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ অকপটে লিখেছেন, ‘...তখন আরবি-পারসি ভাষায় সুপণ্ডিত মোছলমানের অভাব বাংলাদেশে ছিল না। তাঁহাদের মধ্যকার কাহারও কাহারও যে বাংলা সাহিত্যের উপরও যথেষ্ট অধিকার ছিল তাঁহাদের রচিত বা অনুবাদিত বিভিন্ন পুস্তক হইতে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এদিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তাহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই।’ পরিশেষে অনূদিত এই কোরআন শরিফ সম্পর্কে তাঁর সেই অবিস্মরণীয় মন্তব্য, ‘গিরিশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’
মহীয়সী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনও (১৮৮০-১৯৩২) যারপরনাই খুশি হন বাংলায় পবিত্র কোরআন শরিফ-এর অনুবাদে। গিরিশচন্দ্রকে তিনি ‘মোসলমান ব্রাহ্ম’ বলে উল্লেখ করেছেন নিঃসংকোচে। গিরিশচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে তাঁদের দুজনের সম্পর্ক বিষয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘তাঁহার (রোকেয়ার) সঙ্গে আমার মাতৃপুত্র সম্বন্ধ স্থাপিত। সেই মনস্বিনী মহিলা উক্ত ঘনিষ্ঠতার পরিচয় নিজেই প্রদান করিয়া থাকেন। তিনি আমাকে পত্রাদি লিখিতে পত্রে নিজের নাম না লিখিয়া নামের পরিবর্তে “মা”, “আপনার স্নেহের মা” বলিয়া স্বাক্ষর করিয়া থাকেন।’
বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ এবং মুসলমান মনীষী ও তাঁদের অন্যান্য সাহিত্যকর্ম অনুবাদের কল্যাণে তিনি বাংলার মুসলমান সমাজে এতদূর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁকে ‘মৌলবি’ ও ‘ভাই’ গিরিশচন্দ্র অভিধায় অভিহিত করা হতো। সে সময়কার মুসলমান সমাজের পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে তাঁর জীবনীও ছাপা হয়েছে সবিস্তারে। এমন কী তাঁর মৃত্যুর পর শবানুগমন করেছিলেন ব্রাহ্ম ও মুসলমান সমাজের লোকজন সমভাবে।
গিরিশচন্দ্র সেনকে আমরা ‘মৌলবি’ কিংবা ‘ভাই’, যে বিশেষণেই বিশেষায়িত করি না কেন, বাংলার ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হিন্দু ও মুসলমান—এই দুই বৃহৎ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়গত সেতুবন্ধনে যে সবিশেষ ভূমিকা রেখেছিল তাঁর বাংলায় অনূদিত পবিত্র কোরআন শরিফ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কোরআন শরিফ-এর সেই অনুবাদ-কর্মের কাল সোয়া শ বছর পেরিয়ে গেছে খুবই নীরবে। কেউ কিছু লেখেননি। আমরা কি জাতি হিসেবে এতই কৃপণ, অনুদার এতটাই!

Friday, March 9, 2012

প্রযুক্তির ৫ উদ্ভাবন

তরুণদের তৈরি অনেক প্রযুক্তি প্রকল্প মাঝেমাঝেই চমকে দেয় আমাদের। সম্প্রতি শেষহওয়া বেসিসের সফটওয়্যার মেলাতেও দেখা গেল এমন কিছু প্রকল্প।যেগুলো ছিল ‘আবিষ্কারের খোঁজে ২০১২’ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত বাছাই। সেগুলোর পাঁচ প্রকল্প নিয়ে লিখেছেন ইমাম হাসান

অ্যানিমেশন তৈরির সহজ কাণ্ডারি
হাসিনুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন, সাফায়াতুল ইসলাম ও শুভ্র সরকার—এই চার তরুণের হাতেই উদ্ভাবন প্রযুক্তিটার। চারজনই কাজ করছেন একটি অ্যানিমেশন তৈরির প্রতিষ্ঠানে।নিজেদের কাজে নিত্যদিন যেসব সমস্যা চোখে পড়ে, তা নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরা। সেই সঙ্গে এ দেশের অ্যানিমেশন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কী কী করার আছে, তা নিয়েও চলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা। শুধু আলোচনা থেকে বাইরে এসে কিছু করার আগ্রহ জন্মে চারজনেরই। তার পর থেকেই কাজ শুরু করেন তাঁরা। শুরুতে নিজেদের কাজের সুবিধার কথা ভেবেই ধারণাটা নিয়ে বসেন। চার তরুণের কাছেই জানা গেল, বিদেশি সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করে অ্যানিমেশন ছবি বানাতে লাখ লাখ টাকা দরকার। তা ছাড়া সময় লাগে প্রায় বছর খানেক। যে কারণে বাংলাদেশে অ্যানিমেশন মুভি বানাতে আগ্রহী লোক কম। শুভ্র সরকার বলেন, ‘বাংলাদেশে অ্যানিমেশন জনপ্রিয় করতে চাইলে এর উন্নয়নে দরকার আধুনিক যন্ত্রপাতি, যা বিদেশ থেকে আনতে হয় বলে প্রচুর টাকা ও সময় লাগে। এসব দিক বিবেচনা করেই কাজে হাত দিই আমরা।’ কাজও এগিয়ে নেন। প্রস্তুত করেন এমন একটি সফটওয়্যার, যা কিনা আধুনিক অ্যানিমেশন তৈরিতে পারদর্শী। তাঁদের তৈরি ‘অ্যাফোর্ডেবল মার্কার লেস মোশন ক্যাপচার সলিউশন’ সরাসরি মানুষের কঙ্কাল শনাক্ত করে সম্পূর্ণ শরীর নাড়াতে সক্ষম। এ ছাড়া অ্যানিমেশন করতে আলাদা কোনো পোশাকেরও দরকার হবে না, যা অ্যানিমেশন করতে প্রচলিত সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ কম সময় নেয়। খরচও হাতের নাগালে। সফটওয়্যারটি তৈরির পর লোকজনের ফিডব্যাকের জন্যই আবিষ্কারের খোঁজে প্রতিযোগিতায় আসা। সেখানেই আসে প্রথম রানার আপের পুরস্কার।

না দেখেই বই পড়া
‘এমন যদি হতো যে না দেখেই বই পড়া যেত। তাহলে বিশেষ করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য লেখাপড়া আরও সহজ হয়ে যেত। কারণ, তারা চোখে দেখতে না পারায় আর দশজন সাধারণ শিক্ষার্থীর মতো সহজে পড়তে পারে না। এ জন্য অন্যের সাহায্য দরকার পড়ে। তাঁদের এই কষ্ট দূর করতেই বুদ্ধিটা মাথায় আসে। কাজ শুরু করি। বছর দুই আগে তৈরি করি অনলাইন গ্রন্থাগারের এই সাইটটা। এবারে অংশ নিই আবিষ্কারের খোঁজে। তারপর তো সেরা দশে চলে এলাম।’ বলছিলেন আছিয়া খালেদা। আছিয়ার ওয়েবসাইটে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার বইগুলো রাখা হয়েছে। দুটি পদ্ধতিতে বইগুলো পড়া যাবে। ব্রেইল পদ্ধতির বইগুলো নামিয়ে নেওয়া (ডাউনলোড) যাবে। তা ছাড়া আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে টকিং বুক, যা খুললেই নিজে নিজে পড়ে শোনাবে পাঠককে। অর্থাৎ পাঠক তখন হয়ে যাবেন শ্রোতা। তা ছাড়া সারা বিশ্বে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সব খোঁজখবর নিয়মিত পাওয়া যাবে এই সাইটে। এখানে ব্লগের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে। আছিয়া খালেদা বললেন, ‘এবার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করেছি। আগামীতে অন্য প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে কাজ করার ইচ্ছা আছে।’

কোন রোগে কী দাওয়াই
কোন রোগের জন্য কোন ওষুধ খেতে হবে, তা আপনিও বলে দিতে পারেন। বাংলাদেশের কোন কোন প্রতিষ্ঠান কোন কোন ওষুধ সরবরাহ করে, এই কৌতূহল মেটাতে পারেন ঘরে বসেই। ইন্টারনেটে একটি ওয়েবসাইটে বসেই পাওয়া যাবে রোগ আর পথ্যের সব আদ্যোপান্ত। আর ওয়েবসাইটটি তৈরি করেছেন পাঁচ ফার্মাসিস্ট বন্ধু। তাঁরা হলেন সায়হাম আহমেদ বীন হালিম, নাজমুল হাসান, আজহারুল ইসলাম, মেজবাউল গাফফার ও মাহবুবুর রহমান।
যেখানে পাওয়া যাবে রোগ আর ওষুধের প্রায় সব ধরনের তথ্য। সফটওয়্যার মেলায় প্রদর্শন করা হয় এই ওয়েবসাইট। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০ সদস্য হয়ে গেছে সাইটটির। জনপ্রিয়তা বাড়ছে প্রতিদিনই। সাইটটি সম্পর্কে সায়হাম বলেন, ‘আমরা চেয়েছি এই সাইটটা যাতে করে সত্যি সত্যি মানুষের কাজে লাগে। আর তাই আমরা এর ব্যাপ্তি বাড়াচ্ছি প্রতিদিন। এটি একটি স্বাস্থ্যসেবার ওয়েবসাইট।’
কোন ওষুধের নাম কী, সেটি কোন নিয়মে বানানো, কোন কোম্পানির ওষুধ—এসবই জানা যাবে এখানে। মেডিকেল ক্লাসিফিকেশনের মাধ্যমে ওষুধগুলোকে ভাগ করা আছে। এ ছাড়া আপনি যে ওষুধটি খাচ্ছেন, তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কী, জানা যাবে এখানে। কোন ওষুধ খেলে কী বাদ রাখবেন, তা জানতে পারা যাবে এখানে। আর এগুলো জানতে হলে আপনাকে নিবন্ধন করতে হবে বিডিড্রাগস ডটকমে। নিবন্ধন একেবারে বিনা মূল্যে। সারা দেশে হাসপাতালের তালিকা, ঠিকানা ও ফোন নম্বর পাওয়া যাবে এখান থেকে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য দিবসে এখানে পড়তে পারেন বিশেষ কোনো রোগ ও এর আদ্যোপান্ত। পাওয়া যাবে স্বাস্থ্যবিষয়ক চাকরির খোঁজখবর। কোন ওষুধ কোন বাজারে গেলে সহজে পেতে পারেন, তার একটি তালিকা অচিরেই প্রকাশ পাচ্ছে এখানে।

কথায় চলেরোবট
এটি একটি স্মার্ট মোবাইল রোবট। চাইলে সামরিক গোয়েন্দা রোবটের কাজে একে ব্যবহার করা সম্ভব। বিপজ্জনক এবং দুর্গম এলাকায় রোবটটি কাজ করতে পারবে কোনো মানুষ ছাড়াই। মোবাইল ফোনে কথার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তাকে। একইভাবে রোবটের সঙ্গে থাকা ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে সেখানকার ছবিও দেখা সম্ভব। যেহেতু এটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তাই মোবাইলের ফোনের নেটওয়ার্ক আছে এমন যেকোনো দূরত্বে কাজ করতে পারবে রোবটটি। রোবটটিতে তথ্য প্রক্রিয়া করার জন্য এআরএম প্রসেসর এবং যোগাযোগব্যবস্থার জন্য জিএসএম, জিপিআরএস ও জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান ফিরোজ আহমেদ। কথা শণাক্ত করার (ভয়েজ ডিটেকশন) প্রযুক্তিটি চাইলে রোবট বাদে হুইল চেয়ারে সেট করা সম্ভব। তখন এটি হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীর অন্য কারও সাহায্য ছাড়াই নিজের কথার মাধ্যমে এটি চালাতে পারবে। এর বাইরেও অন্য অনেক কমান্ড শিখিয়ে দিলে রোবটটি ঠিকমতো তা সম্পন্ন করতে পারবে। বাসার নানা কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে রোবটটি। ছোটবেলা থেকেই রোবটের প্রতি আলাদা আগ্রহ ফিরোজ আহমেদের। বেশ কিছু রোবট বানিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। তাঁর রোবটের খবর প্রচার করেছে বিবিসি, সিএনএন বা রয়টার্সের মতো সংবাদমাধ্যম। বিভিন্ন সময়ে রোবট বানিয়ে তা কীভাবে মানুষের নানা কাজে লাগতে পারে তা নিজে ভাবেন। তবে এবারের রোবটটি নিয়ে ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘ছোট শিশুদের দেখাশোনা করতে বাসায় এমন একটি রোবটই যথেষ্ট। এমনকি বাচ্চাটির কান্না যদি তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে শিশুটি কেঁদে উঠলেই রোবট নিজে ফোন করে তা জানিয়ে দেবে। আপনি ফোনটি রিসিভের পর কথা বলে রোবটটি চালিয়ে দেখতে পারবেন বাচ্চাটি কেমন আছে।’ এমন নানা সুবিধা দিতে পারবে রোবটটি।
আবিষ্কারের খোঁজে প্রতিযোগিতায় রোবটটি তাই জিতে নিয়েছে চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার।

আপনার হয়ে যন্ত্র বলবে কথা
নিজের মনের ভাব অন্যকে বোঝাতে কথা বা ভাষা ব্যবহার করি আমরা। কিন্তু যাঁরা কথা বলতে পারেন না, তাঁরা যেমন নিজেদের বোঝাতে পারেন না, তেমনি অনেক সময় অন্যকেও বোঝাতে পারেন না। এমনই বাকপ্রতিবন্ধী বা বয়স্ক ব্যক্তির যোগাযোগ সহজ করে দিতেই টকিং অ্যাসিস্ট্যান্ট। যে যন্ত্রটি ব্যবহার করে তাঁরা সহজেই অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারেন। নিজের কাজ সহজ করতে তাঁদের একটি বাটন চাপাই যথেষ্ট। তাঁর কথাটি অন্যকে জানিয়ে দেবে যন্ত্র নিজেই। আর অভিনব এই যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেছেন বজলুর রহমান। নিজে কাজ করছেন একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থাপক হিসেবে।
বজলুর রহমান বলেন, ‘যন্ত্রটিতে রয়েছে বেশ কিছু বাটন, যেখানে দৈনন্দিন কাজে দরকারি কথা ছাড়াও অন্যের সঙ্গে সাধারণ যোগাযোগের নানা কথা সংরক্ষিত আছে। ব্যবহারকারী নিজের ইচ্ছামতো বাটন চাপ দিয়ে অন্যকে তাঁর প্রয়োজনটি সহজে বোঝাতে পারবেন। কথা বলতে না পারা অসহায় মানুষের কথা ভেবেই এমন যন্ত্রের চিন্তা মাথায় আসে। অন্যের কাজে লাগলেই আমার আবিষ্কার সার্থক হবে বলে মনে করি।’ বাংলা ভাষায় তৈরি এ যন্ত্রটিতে সংরক্ষিত কথা ছাড়াও নিজের প্রয়োজনীয় কথাগুলো সংযোজন করে দেওয়া যাবে। সঙ্গে যন্ত্রটির এলসিডি ডিসপ্লেতে ডিভাইস উচ্চারিত বাক্যটি দেখা যাবে।