দুটি আসনের উপনির্বাচনে একটি হারাল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলে হবিগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুশফিক হোসেন চৌধুরীকে এক হাজার ২৮৫ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে বিএনপির প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়া বিজয়ী হয়েছেন।
আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগের র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ৩৯ হাজার ৮২০ ভোটে হারিয়েছেন বিএনপির প্রার্থী খালেদ হোসেন মাহবুবকে।
এদিকে ভোট কারচুপির অভিযোগে রাত সাড়ে ১০টায় বিএনপি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রোববার সেখানে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে।
সরকারের মধ্যবর্তী সময়ে এ নির্বাচনে কোনো ধরনের সহিংসতা ও গোলযোগ হয়নি। শান্তিপূর্ণভাবে সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলে।
ভোট গণনা শেষে গতকাল রাতে রিটার্নিং কর্মকর্তা বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করেন। তাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে মোট ১২৬টি কেন্দ্রের ফলাফলে আওয়ামী লীগের উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী পেয়েছেন এক লাখ ২৪ হাজার ৩৫০ ভোট। আর বিএনপির খালেদ হোসেন পান ৮৪ হাজার ৫৩০ ভোট।
১৯৭৩ সালের পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। সাংসদ লুৎফুল হাই সাচ্চুর মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। লুৎফুল হাই প্রায় ৭৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন।
অপরদিকে হবিগঞ্জের-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের বেসরকারি ফলাফলে বিএনপির প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়া পেয়েছেন ৮১ হাজার ৩৩০ ভোট। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুশফিক হোসেন চৌধুরী পেয়েছেন ৮০ হাজার ৪৫ ভোট। এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আবদুল মুনিম চৌধুরী পেয়েছেন ২২ হাজার ২২০ ভোট।
অবশ্য রাত নয়টার দিকে আওয়ামী লীগের নবীগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি মুজিবুর রহমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের মিলনায়তনে এসে বলেন, ঘোষিত ফলাফলে ভুল আছে। তিনি ফলাফল আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বন্ধ করার দাবি জানান।
একই সময় বিএনপির প্রার্থীর লোকজনও সেখানে এসে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মাইকে ঘোষিত ফলাফলের লিখিত কাগজ দেওয়ার দাবি জানাতে থাকেন। এ নিয়ে সেখানে কিছু সময় উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
রাত ১০টার দিকে স্থানীয় ডাকবাংলোয় রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. এমরান সংবাদ সম্মেলন করে একই ফলাফল ঘোষণা করেন। এর কিছুক্ষণ পর একই স্থানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুশফিক হোসেন চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে ছয়টি কেন্দ্রের পুনর্নির্বাচন দাবি করেছেন। তাঁর অভিযোগ, চা-বাগানের কেন্দ্রগুলোতে তাঁর পক্ষের ভোটারদের হুমকি ও আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে।
হবিগঞ্জের এ আসনে ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেওয়ান ফরিদ গাজী জয়লাভ করেন। এর আগে ১৯৯১ সালে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। দেওয়ান ফরিদ গাজীর মৃত্যুতে এ আসনে উপনির্বাচন হলো।
নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘এ নির্বাচন দেশে ও আশপাশের দেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অতীতে রাজনৈতিক সরকারের সময়ে এমন শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের নজির জানা নেই।’
ভোট গ্রহণ শেষে বিকেলে ঢাকায় বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাঁচটি কেন্দ্র স্থগিত করে পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
সকালে গ্রামে, দুপুরে শহরে লাইন: ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে শরিফুল হাসান ও ওয়ালিদ সিকদার জানান, সকাল থেকেই গ্রামের দিকের কেন্দ্রগুলোতে ছিল লম্বা লাইন। সে তুলনায় শহরের কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল। কিন্তু বেলা যতই বেড়েছে ততই ব্যস্ত হয়েছে শহরের কেন্দ্রগুলো। অনেকে ভোট দিতে এসেছিলেন দুপুরের পরে।
স্থানীয় বিএনপি বলছে, কয়েকটি কেন্দ্র বাদ দিলে সার্বিকভাবে নির্বাচনের পরিবেশ ভালো ছিল। একই কথা বলেছে আওয়ামী লীগও।
নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে এই আসনের চারদলীয় জোটের প্রার্থী খালেদ হোসেন মাহবুব অভিযোগ করে বলেন, আটটি কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টকে বের করে দিয়েছে আওয়ামী লীগের লোকজন। আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থীর পক্ষে সরকারি প্রশাসনকে ব্যবহার করেছে।
বিএনপির প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও শহর বিএনপির সভাপতি শফিকুল ইসলাম প্রথম অলোকে বলেন, সার্বিকভাবে নির্বাচনের পরিবেশ ভালো ছিল। কিন্তু সাত থেকে আটটি কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। বিকেলের দিকে কিছু কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জানিয়েছেন কি না—জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা মৌখিকভাবে অভিযোগ সার্বক্ষণিকভাবে জানিয়েছি।’
এই আসনের মহাজোটের প্রার্থী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনকে বারবার বলেছি, আমি একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই। জনগণ যদি আমাকে ভোট দেয়, তবেই আমি জিততে চাই। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে আমার কর্মীদের মারধর করা হয়েছে। সহিংসতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। আমি সবাইকে ধৈর্য ধরে থাকতে বলেছি। এ কারণেই একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে।’
কুমিল্লা অঞ্চলের উপনির্বাচন কমিশনার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ হয়েছে। একটি কেন্দ্রও স্থগিত করতে হয়নি। প্রার্থীরা মৌখিকভাবে কিছু অভিযোগের কথা বলেছেন। মূলত এগুলো ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা-সম্পর্কিত। তাঁদের অভিযোগ পাওয়ার পরপরই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ ছিল খুবই ভালো।’ এ জন্য সব প্রার্থী, ভোটারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধনবাদ জানান তিনি।
সদর ও বিজয়নগর উপজেলার একাংশ নিয়ে এই আসন। এখানকার মোট ভোটার তিন লাখ ১০ হাজার ২৩৮ জন। ভোটারদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, তাঁদের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ৬৫ শতাংশ ভোট পড়েছে।
বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগ: বিএনপির প্রার্থী খালেদ হোসেন মাহবুব সকাল নয়টার দিকে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, সদর উপজেলার নাটাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে তাঁর এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পরপরই সাংবাদিকেরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা যায়, স্বাভাবিক পরিবেশে ভোট চলছে।
কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শরিফুল হক বলেন, ‘বিএনপির প্রার্থীর অভিযোগ ভিত্তিহীন। শান্তিপূর্ণভাবেই এখানে নির্বাচন চলছিল। কিন্তু বিএনপির প্রার্থী এসে হঠাৎ করে বলেন, তাঁর এজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি এখানে তাঁদের এজেন্টই দেননি। আমি সকালেই বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে জানিয়েছি।’
দুপুর একটার দিকে খালেদ হোসেন মাহবুব অভিযোগ করেন, সদর উপজেলার বাসুদেব উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে সিল মারছে। কয়েকজন সাংবাদিক আবার ছুটে গেছেন সেখানে। গিয়ে দেখা যায়, ভোট গ্রহণ বন্ধ। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ র্যাব-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান।
ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মির্জা গালিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট নেওয়া হচ্ছিল। দুপুরের দিকে দুটি বুথের বিএনপির এজেন্ট নাশতা খাওয়ার কথা বলে বাইরে যান। এরপর বিএনপির প্রার্থী খালেদ হোসেন মাহবুব ওই দুই এজেন্টসহ কয়েকজন সাংবাদিক নিয়ে এসে আমাকে বলেন, “এখানে ভোট বন্ধ করে দেন।” আমি তাঁকে বলি, নির্বাচন তো শান্তিপূর্ণ হচ্ছে। ভোট গ্রহণ কেন বন্ধ করব? এ সময় কেন্দ্রের বাইরে বিএনপির লোকজন ভোট বন্ধের দাবিতে স্লোগান দেয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘটনাটি জানাই। পরে র্যাব-পুলিশ এলে আবার নির্বাচন শুরু হয়।’
বিএনপির প্রার্থী খালেদ হোসেন মাহবুব অভিযোগ করেছেন, খ্রিষ্টিয়ান মিশনারি স্কুল, সুহিলপুর মীরহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুহিলপুর দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুহিলপুর মধ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিরাশার প্রাথমিক বিদ্যালয়, দতাইসার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সাবেরা সোবহান বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি কেন্দ্র থেকে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় পুলিশ, র্যাব ও সন্ত্রাসীরা বিএনপির প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি কেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে মারধর করা হয়েছে। ফলে ভোটাররা আতঙ্কে ছিলেন।
তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ১২৬টি কেন্দ্রের সবগুলোতেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ হয়েছে। কয়েকটি কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থী অভিযোগ দেওয়ার পরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত লোকজন ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। কিন্তু বেশির ভাগ স্থানেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
বিকেল সাড়ে তিনটায় খ্রিষ্টিয়ান মিশনারি স্কুল কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এ এফ এম নওরোজকে লাঞ্ছিত করে বিএনপির কর্মীরা। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিএনপির প্রার্থী নিজেই তাঁকে ধমক ও গালাগাল করে হুমকি দেন।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এ এফ এম নওরোজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাল ভোট পড়ছে, এমন মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে বিএনপির প্রার্থী আমাকে গালিগালাজ করেন। আমি তাঁকে বলি, “আপনার কোনো অভিযোগ থাকলে লিখিত দেন।” কিন্তু তিনি লিখিত দেননি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নরসিংসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে জাল ভোট দিতে গিয়ে বায়েজিদ (১৫) ও আমির হোসেন (২২) নামে দুজন বিএনপির কর্মী আটক হয়েছেন। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবদুর নুর প্রথম আলোকে জানান, যে পরিচয়পত্র নিয়ে তাঁরা ভোট দিতে এসেছিলেন এর সঙ্গে তাঁদের ছবির কোনো মিল না থাকায় তাঁদের আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়।
আমাদের আখাউড়া প্রতিনিধি দুলাল ঘোষ জানান, বিজয়নগর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের ৩৫টি ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টায় মেরাশানী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের লাইনে থাকা ভোটার আক্তার হোসেন (৫৬) বলেন, ‘হুনছিলাম, মিলিটারি আইব। আবার হুনি আইব না। এর লাইগ্গা ভয়ে আছিলাম। কেন্দ্রে আইয়া দেহি, কোনো গুলমালই নাই। হগলেই শান্তিতে ভোট দিতাছে।’
বিএনপির অভিযোগ ছিল, আবার ছিলও না: হবিগঞ্জ থেকে ওয়াসেক বিল্লাহ্ ও হাফিজুর নিয়ন জানান, দুই উপজেলার মোট ১৭৫টি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হয়। কোনো সহিংসতা ঘটেনি। আওয়ামী লীগের সাংসদ দেওয়ান ফরিদ গাজীর মৃত্যুতে আসনটি খালি হয়। নির্বাচনে ভোটারসংখ্যা তিন লাখ এক হাজার ৪৪৭।
রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. এমরান ভোট গ্রহণ শেষে প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০০ ভাগ সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। আমরা সবাই খুশি।’
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অন্তত ২৫টি ভোটকেন্দ্র ঘুরে কোথাও ভোটারদের লম্বা লাইন দেখা যায়নি। দু-একটি কেন্দ্রে ভোটারদের ভোট দিতে লাইন ধরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। বেশির ভাগ কেন্দ্রেই ভোটাররা এসে অপেক্ষা না করেই ভোট দিতে পেরেছেন।
বিএনপির প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়া সকাল নয়টার দিকে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছে। আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।’ বিএনপির সাংসদ নজরুল ইসলামও সকাল ১০টার সময় এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভোট মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে।’ এর মাত্র এক ঘণ্টা পর তিনি একটি ইংরেজি দৈনিককে ২০টি কেন্দ্রে কারচুপি ও সরকারি দলের সন্ত্রাস করার অভিযোগ করেন।
নজরুল ইসলাম যেসব কেন্দ্রের নাম উল্লেখ করেন, তার প্রতিটিই নবীগঞ্জ সদর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। এমন একটি কেন্দ্র বড় বাকৈরের রামপুর সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়। অভিযোগ ছিল, ওই কেন্দ্রের বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রটিতে গিয়ে এই অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। একটি বুথে বিএনপির এজেন্ট আম্বিয়া বেগম বলেন, ‘ভোট ভালো অইছে। ভয় দেহাইছে না কেউ।’ আরেক বুথে বিএনপির এজেন্ট আবদুল খালেক বলেন, ‘খুব ভালো ভোট হইছে। কোনো সমস্যা নেই।’
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আনোয়ারুল আজিম বলেন, ‘শাম্মী আখতার (সংরক্ষিত নারী আসনে বিএনপির সাংসদ) ফোন করেছিলেন। তিনি জানালেন, এই কেন্দ্রে নাকি প্রভাব বিস্তার করা হচ্ছে। আমি তাঁকে বললাম, কই, কিছু হচ্ছে না তো। তখন তিনি বললেন, “ধন্যবাদ, তাহলে ঠিক আছে।’”
বেলা সোয়া দুইটার দিকে বিএনপির প্রার্থীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘খুব ভালো নির্বাচন হচ্ছে। কোনো সমস্যা নেই।’
কিন্তু বিকেল চারটায় বাহুবলের মিরপুর দাখিল মাদ্রাসায় সুজাত মিয়া বলেন, ‘২০-২৫টা সেন্টারে আমাদের কর্মীদের মারধর করা হয়েছে। তাদের ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমাদের এজেন্টদেরও বের করে দেওয়া হয়েছে।’ কোথায় এগুলো হয়েছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা কোথায় ছিলেন? নবীগঞ্জের বহু জায়গায় এগুলো হয়েছে।’ তবে তিনি সুনির্দিষ্ট করে কোনো কেন্দ্রের নাম বলতে পারেননি।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুশফিক হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে ভোট গ্রহণ শেষে বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে।’
জাতীয় পার্টির প্রার্থী আবদুল মুনিম চৌধুরীর প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ভোটারসংখ্যা কম ছিল।’
রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. এমরান বলেন, ‘শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। বিএনপি দু-তিনটি কেন্দ্রে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ করেছিল। তবে তদন্ত করে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। একইভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে ভোটারদের গাড়িতে করে আনা-নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছিল। এরও কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
ভোটার উপস্থিতি কম: বাহুবলের পুঁটিজুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিকেল তিনটা ৪০ মিনিট পর্যন্ত শতকরা ৫৯ ভাগ ভোট পড়েছিল। কেন্দ্রটির পোলিং কর্মকর্তা অমৃতলাল গোপ বলেন, ‘এখন বোরো ধান রোপণের মৌসুম চলছে, তাই হয়তো উপস্থিতি কম।’
আরেক পোলিং কর্মকর্তা জাফরান আহমেদ বলেন, ‘কোনো সময় ভোটারদের একটা লাইনও হয়নি। চার-পাঁচজন করে ভোট দিয়ে চলে গেছে।’
কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবদুল মজিদ বলেন, ‘এখন বোরো রোপণের মৌসুম। গরির মানুষের আয়-রোজগারের দিকও তো আছে। অনেকে আবার এলাকার বাইরে কাজ করে। আবার এই এলাকায় নারীদের বিষয়ে রক্ষণশীলতা আছে। এসব কারণে হয়তো ভোট কম পড়েছে।’
বাহুবল প্রতিনিধি পংকজ কান্তি গোপ জানান, উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে বাহুবল আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা একটায় গিয়ে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য খোশগল্প করছেন। আনসার বাহিনীর মহিলা সদস্যরাও নিজেদের মাঝে পান-সুপারি ভাগাভাগি করে খাচ্ছেন। ৫-১০ মিনিট পর পর দু-একজন ভোটার আসছেন। ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছেন। কোনো লাইন নেই। নেই ভোটকেন্দ্রের চিরচেনা চিত্র।
বেলা আড়াইটায় উপজেলা সদর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে পশ্চিম ভাদেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মহিলা ভোটারদের ছোট্ট একটি সারি। পুরুষ ভোটারদের উপস্থিতি খুবই কম। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বিমল চৌধুরী জানান, শতকরা ৪০ ভাগ ভোট পড়েছে।
কেন্দ্রে এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য আকবর আলী (৭০) বলেন, ‘জীবনে এত কম ভোটার দেখিনি।’ তাঁর মতে, গ্রামাঞ্চলে প্রার্থীদের প্রচারণা কম ও উপনির্বাচন হওয়ায় ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাসুক মিয়া জানান, রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের পেছনে বেশি ছোটাছুটি করেছেন, বাড়ি বাড়ি ভোটারদের কাছে যাননি। ফলে ভোটাররা কম এসেছেন।
উপজেলার বিএম ব্রিকস ফিল্ডে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ শ্রমিক নিজের কাজে ব্যস্ত। শ্রমিক তইয়ব আলী ও আবদুল আজিজ বলেন, ‘ভোট দিয়া কিতা অইত। চাউলের দামত আর কমতনায়। আমি রোজি না করলে পরিবার পালমো ক্যামনে?’ ভোটার উপস্থিতির এ চিত্র শুধু বাহুবল সদর, পশ্চিম ভাদেশ্বর ও যশমঙ্গল কেন্দ্রের নয়; উপজেলার ৬১টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে বেশির ভাগেরই চিত্র ছিল একই রকম।
বাহুবল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দুজ্জামান বলেন, বাহুবলে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ নির্বাচন জাতীয় প্রেক্ষাপটের কোনো পরিবর্তন আনবে না বলে ধারণা থাকায় হয়তো ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহ বোধ করেননি অনেকে।